আমরা কি তবে মনুষ্যত্ব হারাতে চলেছি? নিজেদের মানুষ বলার, মানবিক প্রাণী বলার অধিকার কি হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের?
বিস্তারিত
গতকাল বিকেলে কিছু পরিদর্শন শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে অফিসের দিকে ফিরছিলাম। বুল্লা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় পার হয়ে কিছুদূর আসার পর খেয়াল করলাম একটা লোক রাস্তায় পাশে পা চেপে ধরে বসে আছে। আশেপাশে অনেকেই আছে কিন্তু তার চিৎকারে কেউ এগিয়ে আসছে না। ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে দ্রুত নেমে এগিয়ে গেলাম। লোকটি পা চেপে ধরে ব্যথায় গুঙাচ্ছে আর পা দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। মূলত তার পালিত ছাগলটি একটি অটোর নিচে পড়তে গিয়ে দৌড় দেয়ার সময় তার খুঁটি এসে লোকটির পায়ে মারাত্মক জখম করে। রক্ত বন্ধ করার জন্য কেউ এগিয়ে আসছে না দেখে আমার ড্রাইভারকে বলে গাড়ি থেকে নিয়ে একটা গামছা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিতে বললাম। এই সময়ে এক মহিলা (লোকটির মা) হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখলাম। রাস্তাটা সরু হওয়ায় অনেকগুলো অটো এসে থেমে গেছে ততক্ষণে কিন্তু লোকটিকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য নিকটস্থ ফার্মেসী বা হাসপাতালে পাঠানোর জন্য কাউকে রাজি করাতে পারছিলাম না। আমার নিজের গাড়ি ওভারলোড ছিলো মানুষ দিয়ে নইলে সেই কাজটুকু আমি দায়িত্ব মেনেই করতাম। যাই হোক, অবশেষে একজনকে অনেক অনুরোধ করে রাজি করাতে পারলাম তাকে চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যেতে। সাথে টাকা পয়সা না থাকতে পারে ভেবে সেলাই, টিটেনাস টিকা, যাতায়াত ভাড়া ও ঔষধ কেনার জন্য কিছু টাকাও দিয়ে দিলাম। কিন্তু অটোতে তার সাথে যেতেও কাউকে রাজি করাতে পারলাম না। অবশেষে সমাধান হয়ে এগিয়ে এলেন সেই মমতাময়ী মা। নিজের সন্তানের এই কঠিন সময়ে জরাজীর্ণ শীর্ণ শরীর নিয়েই সন্তানকে আগলে ধরে রওনা দিলেন চিকিৎসা দিতে।
পুরো ঘটনা এতো দ্রুত ঘটে গেলো যে লোকটির নাম ঠিকানাও রাখতে পারলাম না। কিন্তু মন থেকে একটি তাগাদা আসছিল বারবার লোকটির খোঁজ নেয়ার জন্য। অবশেষে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর লাগিয়ে তার নাম পরিচয় বের করতে সক্ষম হলাম গতকাল রাত ৯ টার দিকে। জানলাম পায়ে ৬ টি সেলাই লেগেছে। কিছুদিন কাজকর্ম করতে বারণ করেছে ডাক্তার। কষ্ট লাগলো লোকটার আর তার পরিবারের কথা ভেবে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার জন্য তারা তো কেউ প্রস্তুত ছিল না। পরে আজ সকালে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লোকটির বাসায় ১ সপ্তাহ চলার মত খাবার আর নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
আমি এরকম ঘটনাগুলো সাধারণত শেয়ার করি না কারণ অনেকেই অনেক ধরণের মন্তব্য করেন। কিন্তু আজকে শেয়ার করার পিছনে একটা কারণ আছে। সেই লোকটি যখন রাস্তায় একা বসে কাতরাচ্ছিল তখন আশেপাশে আরো ৪/৫ জন লোক থাকলেও কেউ এগিয়ে পর্যন্ত আসে নি। অটো ঠিক করে দেয়ার পর কেউ তাকে চিকিৎসা দিতে নিয়ে যেতে পর্যন্ত রাজি হয় নি।
আমরা কি তবে মনুষ্যত্ব হারাতে চলেছি? নিজেদের মানুষ বলার, মানবিক প্রাণী বলার অধিকার কি হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের?